ফুলদীর তেঁতুল গাছটি ৬০০ বছরের ইতিহাস

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি : ডালপালা ছড়িয়ে বেশ খানিকটা জমি দখল করে আছে ফুলদী কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের ৬০০ বছরেরও বেশী পুরাতন তেতুল গাছটি। ৬০০ বছরেরও বেশি বয়স্ক এ তেঁতুল গাছটি এক নজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন মানুষজন। দূর থেকে দেখে গাছটিকে দেখলে মনে হবে বিরাট আকারের একটি বটগাছ।

 

এ গাছ নিয়ে এলাকায় রয়েছে মুখোরোচক নানা গল্প। গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের ফুলদী গ্রামের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেঁতুল গাছটি। বৃদ্ধ এই গাছটির নিচে প্রতিদিন নানা বয়সী মানুষ শীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়ান। গাছটির পাশেই রয়েছে ফুলদী গাউসিয়া সুন্নীয়া দাখিল মাদরাসা, ফুলদী হাফিজিয়া মাদরাসা ও আমটেকী জামে মসজিদ।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, ঈদগাহর সুবিধার্থে কমিটির উদ্যোগে গাছটির চারপাশ পাকা করা হয়েছে। বিশাল তেঁতুল গাছটির মোটা ডালগুলো আশপাশের জমিতে ছড়িয়ে আছে। প্রতি বছর গাছটিতে তেঁতুলও হয় প্রচুর পরিমাণে। যা বিক্রি করে ঈদগাহর উন্নয়ন করা হয়। ঈদগাহ পরিচালনায় রয়েছে একটি কমিটি।

 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে ইকতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বঙ্গ জয় করেন। তাঁর বিজয়েরপর সুষ্ঠু শাসনকার্য্য পরিচালনার সুবিধার্থে বঙ্গ বা বাংলাকে একাধিক ভাগে ভাগ করা হয়। সে সময় প্রতিভাগে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে খলজি দিল্লী ফিরে যান। মধ্য বঙ্গের শাসনকর্তা বা সুবেদার হিসেবে নিযুক্ত করেন খলজির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা মুহাম্মদ আউলীয়া খাঁকে।

 

সুবেদার আউলীয়া খাঁ দায়িত্ব পেয়ে তার প্রাশাসনিক কেন্দ্র বর্তমান বক্তারপুর এলাকায় গড়ে তুলেন। সে সময় ‘বখতিয়ারের ক্যাম্প’-এ লোকজনের পদচারনা শুরু হতে থাকে। পরবর্তীতে ক্যাম্পকে ঘিরে সেখানে গড়ে উঠে বাজার (বাজার ফার্সি শব্দ ‘পুর’ )। তখন মানুষজন যারা বাজারে আসতেন তাদের জিজ্ঞাস করা হলে বলত ‘বখতিয়ার ক্যাম্প বা পুর’ যাচ্ছি। পরবর্তীতে লোকমুখে ‘বখতিয়ার ক্যাম্প বা পুর’-ই হয়ে উঠে আজকের বক্তারপুর।

 

সুবেদার আউলীয়া খাঁ প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে এলাকা ঘুরে বেড়াতেন। খোজ নিতেন প্রজাদের সুখ-দুঃখের। একদিন তিনি আজকের ফুলদী বা তৎসময়ের ফুলহরীতে আসেন। তার কাছে জায়গাটি পছন্দ হলে তিনি ফুলহরীতে আবাসস্থল গড়ে তুলেন এবং এখানেই বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তীতে তার বংশধরেরা এখানে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর বংশধরের কোন এক পুরুষ রোপন করেছিলেন এই তেতুল গাছটি। যা ফুলদীর ইতিহাস ঐতিহ্যের কালের সাক্ষী হয়ে আজো দাড়িয়ে আছে ঠায়।

 

ইতিহাস ও জমিজমা সক্রান্ত হিসেব থেকে ষ্পষ্টত দেখা যায় ঈদগাহ’র জামির সর্বশেষ মালিকানাও ছিল সুবেদার আউলীয়া খাঁ’র বংশধর তৎকালীন ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর ( রূপগঞ্জ সার্কেলের ) সার্কেল ইন্সপ্যাক্টর অব পুলিশ মুন্সী মুহাম্মদ মাগন ছরওয়ার খাঁ। তিনিই এই ঈদগাঁহটি ওয়াকফ করে গেছেন। কিছুদিন পূর্বে ঈদগাহ কমিটি ওয়াকফের কাগজপত্র ঠিক করেছেন বলে জানাগেছে।

ই তেতুল গাছটির রোপণ সম্পর্কে অত্র এলাকার প্রবীন মুরুব্বী শেখ সাহেব আলী মাতব্বর এই এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেষ্ট ব্যক্তি মরহুম মুক্তাজুল হোসেন খান রাজা মিয়ার সূত্র টেনে বলেন, এই তেতুল গাছটি কম করে হলেও ৬০০ বছরের পুরাতন। তিনি বলেন, ‘আমি মিয়া সাহেবের (রাজা মিয়া) কাছ থেকে শুনেছি তিনি তাঁর দাদা, পরদাদা এভাবে বহু পূর্ব ইতিহাস ঘেটে বলেছেন, এ গাছটি ৬শ বছর আগেকার। আমি এভাবেই নিশ্চিত হয়েছি’। এসময় তিনি বলেন, ‘কারোর সন্দেহ থাকলে গাছটির ডিএনএ টেষ্ট করে বের করুক না কত বছরের পুরাতন’।

 

 

 

ফুলদী গাউসিয়া সুন্নীয়া দাখিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সুপার মাওলানা মো. বাহাউদ্দিন বলেন, ২২ বছর আগে তার চাচা শাহাজউদ্দিন সরকার ১১৫ বছর বয়সে মারা যান। এ গাছটি সম্পর্কে তিনি তার ওই চাচার কাছ থেকেই শুনেছেন। তার চাচা আবার তার দাদার কাছ থেকে। এভাবেই আনুমানিক ৫০০/৬০০ বছরেরও বেশি সময় কালের সাক্ষী হয়ে আছে ফুলদীর ওই তেঁতুল গাছটি।

গাছটির মালিকানা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যাস্ত। তিনি আরো বলেন, ওই গাছটি নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। লোকমুখে জানাগেছে, সাদা পোশাক পরিহিত অনেক লোক বিলের পানির উপর দিয়ে অনায়েশে হেঁটে গাছটির পশ্চিম পাশে সুবেদার আউলীয়া খাঁ’র বংশধর মহান আল্লাহর ওলীয়ে-কামেল নাদু ইব্রাহীম খাঁর ঈমামতিতে নামাজ আদায় করতেন। এসময় সমস্ত এলাকা ফুলের সুবাসে সুবাসিত হয়ে পড়তো।